রঙিন

মুক্তির গান (মার্চ ২০২৪)

ম ই সিদ্দিকী
  • ৫০
খোরশেদ যেদিন মা’য়ের দু’আ নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকাতে এসেছিল সেদিন সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছিল; হয়ত মুষলধারে, নয়ত ঝিরঝিরে। শহরে আসার আগে খোরশেদের গ্রাম ছাড়তে মন যেন টই-খই করে উঠছিল- গ্রামে যে তার কোন কদর নেই! কে বুঝবে তার প্রতিভা? এমনিতে তার অনিচ্ছার পেশা গ্রামের মাঠে ফসল ফলিয়ে টাকা যা আয় রোজগার হয়, তা দিয়ে তেমন কিছু হয় না। তাই সে মনে করত নিজের প্রতিভা একটু বাজিয়ে না দেখে এইভাবে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে গ্রামে পরে থেকে তো আর লাভ নেই, সে কারণে সে মায়ের দু’আ আর জমি বন্ধক রেখে যে টাকা পেয়েছিল তা নিয়ে সে ঢাকায় পারী জমাতে চেয়েছে। মায়ের প্রতি খোরশেদের ভালোবাসা অনেক, কেননা তার কাছ থেকে সে তার প্রতিভা পেয়েছে বলে তার মনে করে, তাছাড়া অনেকে আছে যারা সত্যিকারের মা ভক্ত ছেলে, খোরশেদ যে সেটা’ই। মা যখন অনুমতি দিয়েছিল তখন’ই খোরশেদ তার পরিকল্পনা মাফিক জমি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করে ঢাকা রওনা হয়েছিল। অনেকে নিষেধ করেছিল, অনেকে আবার বলেছিল- “যা, এখানে থেকে করবি কি?”- সব ভালো মন্দ মনে রেখে খোরশেদ ঢাকায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসেছিল।

খোরশেদ ঢাকায় এসে উঠেছিল তার দূর-সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে। আগে থেকে যোগাযোগ করে এসেছিল, তাই সমস্যা হয় নি কোন। তাছাড়া খোরশেদ এত বোকা সোঁকা কিংবা সহজ সরল না যে তার মাথায় যে কেউ কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে। হালকা পাতলা, গায়ের রং কালো, পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির খোরশেদ তাই ঢাকা এসে’ই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে ছিল, পেরেছিল’ও। ঢাকায় এসে তার যে খারাপ লাগা শুরু হয়েছিল, তা দূর করতে মনের ভিতরে পুষিয়ে রাখা শখ- চিড়িয়াখানা দেখা আর এফ ডি সি’র দরজায় তাকে দেখা গিয়েছিল। শহরের লাবণ্য-ময় মেয়েদের চোখের দেখা তো সাথে ছিল’ই। হাতির-ঝিলের পাশে হেঁটে যেতে যেতে শহরের কোন এক মেয়েকে বিয়ে করে, মা-কে নিয়ে আসবে এই পরিকল্পনা সে তার দূর-সম্পর্কের সেই চাচাতো ভাইকে বলেছিল’ও।

তার কিছুদিন পর সে আটঘাট করে তার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। চাচাতো ভাইয়ের কাছে কমিশনের মাধ্যমে ফুড ভ্যান কেনা থেকে শুরু করে এলাকার কিছু মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে নিয়েছিল; কারণ সে আগেই বুঝতে পেরেছিল- এভাবেই শুরু করতে হবে। ফুড ভ্যানের প্রতি তার চকচকে চোখ বলে দিয়েছিল সে এবার তার প্রতিভা- পিঠা বানানো- যা দিয়ে সে তার ভাগ্য ফেরাতে পারবে, তার অপেক্ষার অবসান ঘটছে। তাই সে গাল ভরা নাম’ও ঠিক করেছিল- “মায়ের দু’আ পিঠা ঘর”।

যেদিন সে তার পিঠা বানানো শুরু করেছিল- তার আগের দিন অনেক খোজা-খুঁজি করে পিঠার সরঞ্জাম কিনে ফিরতে ফিরতে মধ্য রাত হয়ে গিয়েছিল, আর সে দিন’ই তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই বুঝে গিয়েছিল- খোরশেদকে দিয়ে কিছু একটা হবে হয়ত। তাই সে পরদিন ভোর সকালে খোরশেদের ঢাকায় বানানো প্রথম পিঠা খেয়ে নিশ্চিত করেছিল। আর এইদিকে খোরশেদ যখন বহু দু-চিন্তা আর আধা ঘুম-জাগরণের রাতের পর প্রথম পিঠা’টিই ঠিক ভাবে বানাতে পেরেছিল তখন’ই সকল দু-চিন্তা মুক্ত হয়ে মনে মনে বলেছিল- ফুড ভ্যানের নামের সার্থকতা আছে, আর তার প্রতিভার এবার সঠিক বিচার হবে।

প্রথম দিনে বিক্রি ভালো ছিল খোরশেদের। যারা যারা পিঠা খেয়েছে, তারা তারা বলেছে, অনেক ভালো পিঠা বানাও তুমি কিংবা আপনি। সত্যি তো, সত্যি সত্যি সেদিন খোরশেদ নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছিল। এতদিনে তার গ্রামের মাঠের কাজের অনীহার আসল কারণ সে বুঝে উঠেছিল, আর লাভের অংশ দিয়ে সে নিজের পছন্দের বিরিয়ানি সে আর তার দূর-সম্পর্কের চাচাতো খেয়েছিল। খোরশেদ চালাক চতুর মানুষ। সে ঢাকার পথে কিছুদিন থেকেই বুঝে গিয়েছিল এভাবে যেখানে সেখানে ভ্যান নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে বিক্রি ভালো হবে না। সে তাই একটি ভালো মানের বিদ্যালয়ে সামনে বসার অনুমতি জোগাড় করে নিয়েছিল। তারপর তার মনের শান্তির সাথে সাথে ব্যবসার শান্তি দেখা দিয়েছিল। স্কুলের ছেলে-মেয়ে তার পিঠা খেয়ে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছিল। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক’রাও একই ভাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল। তাই বিক্রি বাড়ছিল হু হু করে। অনেকে ছবি শেয়ার করছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বেড়ে গিয়েছিল খোরশেদের পিঠা বিক্রি। অনেকে গাড়ি থেকে নেমে সখীদের নিয়ে গ্রাম-বাংলার পিঠা খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। স্কুলের অনেক অভিভাবক মন্তব্য করেছিল- গ্রাম-বাংলার পিঠা সত্যি সত্যি মনের তৃপ্তি দেয়।

চার মাসে খোরশেদের রমরমা অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। খোরশেদের যেমন ভালো লাগত তার প্রতিভার সম্মান যেমন মানুষ দিচ্ছিল, তেমনি সে যে জমি বন্ধক রেখেছিল তা ছাড়ানোর উপায় সে যেমন ভাবে ভেবেছিল তেমন ভাবেই হচ্ছিল। হুররে… তার শেখা একটি নতুন শব্দ বলে, মনে বিশাল আনন্দ নিয়ে, সে যখন ইদে রাড়ি যাচ্ছিল তখন তার মা, সবচেয়ে বড় বোন যে খুবই করুণ আর্থিক অবস্থায় দিন কাল পার করছিল এবং ভাইগ্না ভাইগ্নীদের জন্য জামা-কাপড় কিনে নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। স্কুলের চতুর্থ শ্রেণী না পাশ করা এক ছেলে যে মাঠের কাজে’ও মন দিতে পারছিলো না, যার ভবিষ্যৎ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দেখতে পাচ্ছিলো না, আর যার হাতের রান্নার সবাই প্রশংসা করে বলে যে, মায়ের মত হাতের রান্না পেয়েছে তার মেয়েরা না, ছেলে- এই খোরশেদ; সেই খোরশেদ অনেক কিছু করা শুরু করেছে মাত্র!

ইদের পর পরিস্থিতি পালটে গিয়েছিল, আগের মত খোরশেদের পিঠা আর কেউ খাচ্ছিল না। এমন ছিল না যে, তার বানানো পিঠার স্বাদ কমে দিয়েছিল, বরং পিঠার স্বাদ বেড়েছিল আগের চেয়ে; দেখতে’ও ভালো হচ্ছিলো, তবু’ও বিক্রি কম হচ্ছিলো। চিন্তার ভাজ খোরশেদের কপালে বাড়তেই ছিল। মায়ের দু’আ কি তবে কম পড়ে গিয়েছিল? তা তো সম্ভব ছিল না। সেবার’ও আসার সময় মা গালে হাত লাগিয়ে দু’আ করে দিয়েছিল। তবে? পরে এমন এক মাস গেল যে মাসে লাভের কোন টাকা’ই খোরশেদের হাতে ছিল না। কি থেকে কি হয়ে গেল খোরশেদ বুঝে গিয়েছিল সব, খুব দ্রুত।

রঙিন। রঙিন। রঙিন।

স্কুলের বাচ্চা বলুক আর তাদের অভিভাবক’ই বলুক, সবাই রঙিন জিনিস চায়। বাংলার পাটিসাপটা, খোলাজালি পিঠা, পুলি পিঠা, চিতই পিঠা, পানতোয়া, নকশি পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, সরভাজা বেশী দিন চায় না, চায়- বার্গার, পিজ্জা, ভেজিটেবল রোল, মম, স্যান্ডউইচ, হট ডগ ইত্যাদি। সব চাকচিক্য।

হঠাৎ একদিন খোরশেদ বুঝে গিয়েছিল সব, আর তাই একদিন পুরো রাত না ঘুমিয়ে পিঠা বানানো বাদ দিয়ে বার্গার, পিজ্জা, ভেজিটেবল রোল, মম, স্যান্ডউইচ, হট ডগের সামগ্রী কিনে বানানো শুরু করে দিলো। সে জানে তার দেশি পিঠার মত স্বাদ সে আর কোথাও বানিয়ে দিতে পারবে না, কিন্তু তার ই বা কি করার আছে? কারণ সে এটাও জানত এই রকম স্কুলের যায়গা সে একবার ছেড়ে দিলে হাজারো যায়গায় সে পিঠা বিক্রি করে বেশী দিন টিকে থাকতে পারবে না।

রঙিন। রঙিন। রঙিন।

বিক্রি বাড়ল।

তাই খোরশেদের “মায়ের দু’আ পিঠা ঘর” ফুড ভ্যানের নামটা ছাড়া আর বাকি সব পরিবর্তন হয়ে গেল।

—----------------- শেষ —--------------------------
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

খোরশেদ যেদিন মা’য়ের দু’আ নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকাতে এসেছিল সেদিন সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছিল; হয়ত মুষলধারে, নয়ত ঝিরঝিরে

২৭ জানুয়ারী - ২০২৪ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪